মেহেদী হাসান : ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গোয়ালন্দ মহুকুমায় (বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা) রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি বলতেই সামন্তবাদের ধ্যান ধারণায় বিশ্বাসী মুসলিম লীগের কতিপয় ব্যক্তিবর্গ। এ সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর প্রতিবাদ শুরু করলো ছাত্ররা। মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই স্বৈর শাসনের স্বরূপ প্রকাশ পেল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের জন্ম হয় এবং এর মাত্র দেড় বছরের মাথায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন মহুকুমা শহর গোয়ালন্দে (বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা) আওয়ামীলীগের নেতৃত্ব দেওয়ার মত তেমন কোন ব্যক্তি ছিলনা। এরুপ সংকটময় মূহুর্তে বঙ্গবন্ধুর চাচাতো ভাই প্রয়াত ডাঃ এস এম ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে রাজবাড়ীতে আওয়ামীলীগের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু তখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি সে পর্যায়ে না থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে পাকিস্তান শাসন বিরোধী একটা জনমত গড়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। কৃষক শ্রমিক পার্টির সভাপতি ছিলেন শেরেবাংলা একে এম ফজলুল হক। এভাবে ৫ টি সংগঠন মিলে ১৯৫৪ সালে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। ওই সময় অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্টতা অর্জন করে। গোয়ালন্দ মহুকুমার এ আসনটিতে তখন যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা মরহুম এ্যাডঃ আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী।
পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিকভাবে রাজবাড়ীতে (সাবেক গোয়ালন্দ মহুকুমা) আওয়ামী লীগের কর্মকান্ডে দুর্বলতা দেখা দিলে প্রবীণ কিছু রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি তরুণ ও উদ্যোমী নেতৃত্বের সন্ধানে প্রয়াত কাজী হেদায়েত হোসেনকে সামনে নিয়ে আসেন। এদের মধ্যে প্রয়াত বিন্দাবন দাস,অমল কৃষ্ণ চক্রবর্তী ও জাহ্নবী কুন্ডুর নাম উল্লেখযোগ্য। শুরু হয় কাজী হেদায়েত হোসেনের রাজনৈতিক জীবন।
রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত হওয়ার আগেই রাজবাড়ীর ক্রীড়া, শিক্ষা সহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৬১ সালে রাজবাড়ীর সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ রাজবাড়ী কলেজ (বর্তমানে রাজবাড়ী সরকারী কলেজ) প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যেক্তা ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন। তৎকালীন মহুকুমা প্রশাসক (পরবর্তীতে শিক্ষা সচিব) মরহুম কাজী আজাহার আলী সাহেবের অনুপ্রেরণায় এ কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। মহুকুমা প্রশাসক (এসডিও) হিসেবে কাজী আজাহার আলী ছিলেন কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এবং মরহুম কাজী হেদায়েত হোসেন ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। মূলতঃ রাজবাড়ী কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক যোগানদাতা ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন। শুধু কলেজ প্রতিষ্ঠাই নয় কলেজে অধ্যয়নরত অনেক গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করতেন তিনি। তবে এই অর্থ যাতে কোন ছাত্র-ছাত্রী অপচয় করতে না পারে সেজন্য তিনি কাউকে নগদ টাকা হাতে না দিয়ে চাহিদা মাফিক বই, খাতাসহ শিক্ষা উপকরণ কিনে দিতেন এবং কলেজের টিউশন ফি পরিশোধ করে দিতেন। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্য রাজবাড়ী কলেজের হিন্দু ও মুসলিম হোস্টেলের বাইরেও তিনি নিজ উদ্যোগে রাজবাড়ী শহরে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন। এটি তার দুরদর্শী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। ওই সময়কালে গোয়ালন্দ মহুকুমার এসএসসি পরীক্ষার একমাত্র কেন্দ্র ছিল রাজবাড়ীতে । একারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে শত শত ছেলেমেয়েকে রাজবাড়ীতে অবস্থান করতে হত। কিন্তুু গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর রাজবাড়ী শহরে থাকা খাওয়ার সুযোগ ছিলনা। কাজী হেদায়েত হোসেনের ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় এসব ছাত্র-ছাত্রীর থাকা খাওয়ার পুরো ব্যবস্থা হত। এর সুবাদে অনেকেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেছে।
১৯৬০ সালে কাজী হেদায়েত হোসেন রাজবাড়ী মিউনিসিপিলিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। রাজবাড়ীর ক্রীড়াঙ্গনেও ছিল তার সরব উপস্থিতি। এরই অংশ হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “বয়েজ ক্লাব”। এতদ্বঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গনে বয়েজ ক্লাবের পরিচিত ছিল স্মরণ করার মত। কাজী হেদায়েত হোসেন এই ক্লাবের প্রধান পৃষ্টপোষকও ছিলেন। বয়েজ ক্লাবের কার্যক্রম রাজনীতিতে কাজী হেদায়েত হোসেনকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকার ধারাবাহিকতায় তিনি মহুকুমা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ রাজবাড়ী স্টেটিয়ামটি কাজী হেদায়েত হোসেন স্টেডিয়াম হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। মৃত্যুর দিনও তিনি এই স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজের তদারকী করেন।
পাকিস্তানের লাহোর জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ ছিল কাজী হেদায়েত হোসেনের জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তিনি রাজবাড়ী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় (সাবেক গোয়ালন্দ মডেল হাইস্কুল) ও আরএসকে ইনস্টিটিউশন এর ছাত্রদের নিয়ে ওই জাম্বুরীতে অংশ নেন। তৎকালীন সময়ে সরাসরি ট্রেনযোগে স্কাউটরা লাহোরের ওই স্কাউট জাম্বুরীতে যোগদান করেন। এর পুরো নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করেন কাজী হেদায়েত হোসেন।
১৯৬২ সালে কাজী হেদায়েত হোসেনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় মহুকুমা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরের বছর ১৯৬৩ সালে রাজবাড়ী কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে তারই প্রত্যক্ষ ভূমিকায় ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে প্রয়াত এ্যাডঃ চিত্তরঞ্জন গুহ (ভিপি) ও নাজিবর রহমান (জিএস) সহ পূর্ণ প্যানেল জয়লাভ করে। ছাত্রলীগের এই বিজয় এবং শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির উপর ভর করেই রাজবাড়ীতে আওয়ামীলীগের শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে আইয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দীতা করেন। সেই সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশের অধিকাংশ মহুকুমায় মুসলিম লীগ প্রার্থী আইয়ুব খান বিজয় লাভ করলেও রাজবাড়ীতে আওয়ামীলীগ সহ বিরোধী দলীয় প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ জয়লাভ করেন। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন। পরবর্তী সময়ে সকল রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক কর্ম দক্ষতা এবং বিপুল জনসমর্থনের কারণে দলগতভাবে বিশেষ কোন পদে আসীন হওয়ার আগেই তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে মহুকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি রাজবাড়ী অঞ্চলের প্রধান সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। এখানকার যুব সমাজকে সংগঠিত করে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান সহ সকল প্রতিরোধ কার্যক্রমে তার বলিষ্ট ভূমিকা ছিল। এ অপরাধে শহরের সজ্জনকান্দা এলাকায় তার নিজ বাড়ীতে স্বাধীনতা বিরোধীরা অগ্নিসংযোগ করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল রাজবাড়ী শহরে পাক আর্মি প্রবেশের পর কাজী হেদায়েত হোসেনসহ অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা বালিয়াকান্দির রামদিয়া এলাকায় অবস্থান করে। এই খবর পেয়ে রাজবাড়ীর বিহারী-অবাঙ্গালীরা রামদিয়ায় হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অপরাধে সেখানকার নিতাই চন্দ্র সরকার সহ ২শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। অনেকের বাড়ী-ঘর লুটপাট ও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ইতিহাসে এটি রামদিয়া ম্যাসাগার হিসেবে পরিচিত। এরপর কাজী হোদায়েত হোসেন সহ সকলেই প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতে যান। কাজী হেদায়েত হোসেন ভারতের কল্যাণীতে ইয়ুথ ক্যাম্পের পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন।
স্বাধীনতা উত্তরকালে রাজবাড়ীর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে কাজী হেদায়েত হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও বলিষ্ট নেতৃত্বের কারণে এতদ্বঞ্চল (সাবেক গোয়ালন্দ মহুকুমা) আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাটি হিসেবে পরিচিত ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাত্র ৩ দিন পর প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাজবাড়ী শহরের কলেজ রোড এলাকায় তাকে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময়ের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছে শোনা যায় তিনি সেদিন বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে কলেজ সংলগ্ন নিজের ইটভাটা থেকে বের হয়ে রিক্সাযোগে রাজবাড়ী শহরে আসার জন্য রওনা হন। রিক্সা কিছুদুর আসামাত্র পূর্বে থেকেই ওৎপেতে থাকা প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তার বুকে গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এসময় তার সাথে থাকা ঠিকাদার আব্দুস শুকুর মোল্লা (বাদশা মিয়া) দুস্কৃতিকারীদের ছোড়া গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। এখবর ছড়িয়ে পরলে রাজবাড়ীর সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। সেদিন তার পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় ছিলেন। জরুরী দু’একটি কাজ সেরে তারও ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তুু ভাগ্যের নির্মম পরিণতি। ঘাতকের বুলেট কেড়ে নিল তার জীবন। ঢাকায় যাওয়ার আর সুযোগ হয়নি।
কাজী হেদায়েত হোসেনের পৈত্রিক নিবাস শহরের ধুঞ্চি এলাকায়। তার পিতার নাম কাজী আব্দুল হামিদ। তার চার কন্যা ও ৭ পুত্র রয়েছে। জ্যেষ্ঠ পুত্র আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও এবং মেজ ছেলে কাজী ইরাদত আলী রাজবাড়ী চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি এবং জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলকে সুসংগঠিত রেখেছেন।
কাজী হেদায়েত হোসেনের ৪৭তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে রাজবাড়ী পৌর আওয়ামী লীগ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সকাল থেকে কোরআনখানী, কবর জিয়ারত, আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়াও পারিবারিক ভাবে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন।