স্টাফ রিপোর্টার : ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দকৃত বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, শিশু কার্ড সহ সরকারী ঘর দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন অসহায় ব্যক্তির কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া ও ভুক্তভোগীদের হুমকি ধামকির অভিযোগ উঠেছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার চন্দনী ইউনিয়নের (৭,৮ ও ৯) নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য (মহিলা মেম্বর) নার্গিস আক্তারের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ভুক্তভোগী অনেকেই প্রতিকার চেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন। চেয়ারম্যান ওই অভিযোগ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর পাঠিয়েছেন। এ ঘটনায় রাজবাড়ী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. খায়ের উদ্দিন আহমেদ তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন।
চন্দনী রাজবাড়ী সদর উপজেলার আওতাধীন একটি ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের চন্দনী, হরিণধরা, আজুগরা এলাকার অসহায় ব্যক্তিকে প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় দুই থেকে তিন বছর আগে টাকা নেয় বর্তমান সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বর নার্গিস আক্তার। ওই সময় তিনি উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আলেয়ার সাথে থাকতেন। পরবর্তীতে ২০২১ সালের (২৬ ডিসেম্বর) নির্বাচনে তিনি চন্দনীর (৭,৮ ও ৯) ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বর নির্বাবিত হলেও ভুক্তভোগীরা এখনও পান নাই ঘর বা কোন কার্ড । ফেরত পান নাই টাকা। এদিকে ভুক্তভোগীর অনেকেই ওই সময় সুবিধা নেবার আশায় ধার ও সুদের ওপর টাকা এনে দিয়েছেন নার্গিসকে। যার সুদ এখনও তারা বহন করছেন।
চন্দনীর ভ্যান চালকের স্ত্রী অনোয়ারা বেগম। তিনি ঘর ও প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ডের জন্য প্রায় দুই বছর আগে ৩২ হাজার ৫শ টাকা দেন বর্তমান মহিলা ওয়ার্ড মেম্বর নার্গিসের হাতে। এরমধ্যে ১৫ হাজার টাকার সুদ তিনি এখনও টানছেন। কিন্তু এখনও পান নাই ঘর বা কার্ড। একই এলাকার অটোরিক্সা চালক ইব্রাহিম মোল্লা। তিনি প্রায় তিন বছর আগে একটি ঘরের জন্য দিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া ওই এলাকার নবীরুন নেছা বয়স্ক ভাতা কার্ডের জন্য ৩ হাজার, আলেয়া বেগম ৯ হাজার, মহিরুন ৫ হাজার, প্রতিবন্ধী কার্ডের জন্য অরুনা রায় ৫ হাজার, শাহানা ৫ হাজার, আছিয়া ৫ হাজার সহ অনেকে সুবিধা পেতে টাকা দিয়েছেন। দু’একজন ছাড়া কেউ পান নাই কোন সুবিধা।
ভুক্তভোগী ইব্রাহিম মোল্লা বলেন, তিনি ভাড়ায় ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালান। বাড়ীতে ভাল একটি ঘর নাই। বর্তমান মহিলা মেম্বর নার্গিস ৩ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকার ঘর দেবার কথা বলে প্রায় ২ বছর আগে তার কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত ঘর দেয় নাই। এখন টাকা ফেরত চাইলে গেলে তালবাহানা করছেন। শুধু তিনি না, অনেক লোকের কাছ থেকে লোভ দেখিয়ে টাকা নিয়েছে মহিলা মেম্বর। এখন উপায়ন্ত না পেয়ে ইউনিয়ন পরিষদে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
আনোয়ারা বেগম নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, প্রতিবন্ধী কার্ড ও সরকারী ঘর দেবার প্রলোভন দেখিয়ে দুই বছর আগে ৩২ হাজার ৫শ টাকা নিয়েছে নার্গিস মেম্বর। এরমধ্যে ১৫ হাজার টাকা সুদের ওপর নিয়ে দিয়েছিলেন। এখন প্রতিমাসে ওই ১৫ হাজার টাকার জন্য দেড় হাজার করে টাকা সুদ দিচ্ছেন। কিন্তু ঘর, কার্ড বা টাকা কোনটাই পান নাই। মেম্বরের কাছে গেলে নানান কথা শোনায়। যার কারণে চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন।
চন্দনীর মোঃ জালাল মন্ডল বলেন, তার মায়ের বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেবার কথা বলে এক বছর আগে ৩ হাজার টাকা নিয়ে আজ পর্যন্ত কার্ড করে দেয় নাই। পরে বিষয়টি ইউপি চেয়ারম্যানকে জানালে ওই মহিলা মেম্বরের স্বামী এসে তাদেরকে ধমকায়ছে।
শাহনাজ বেগম বলেন, একটা কার্ড হলে সংসার একটু ভাল চলবে। এই ভেবে প্রায় আড়াই বছর আগে ৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন নার্গিসের হাতে। তখন তিনি উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আলেয়ার সাথে থাকতেন। যখন টাকা দিয়েছেন তখন তিনি মেম্বর ছিলো না। গতবছর মেম্বর হইছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্ড বা কিছুই করে দেয় নাই। এখন টাকা চাইতে গেলে বকাবাজি করে। আর এই চন্দনী গ্রামের বহু মানুষের টাকা তিনি নিয়েছেন।
স্থানীয় মুন্না, দীপালি সহ কয়েক জন বলেন, চন্দনীর ৭,৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বর হবার আগেই নার্গিস চন্দনী, আজুগরা, হরিণধরার বহু মানুষের কাছ থেকে সরকারী ঘর সহ বিভিন্ন ভাতা কার্ড করে দেবার কথা বলে টাকা নিয়েছেন। কিন্তু কাউকে সুবিধা দেয় নাই। আজ ওই অসহায় ব্যক্তিরা টাকা চাইতে গিয়ে হয়রানি হচ্ছে। তাই সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে এর বিচার এবং ক্ষতিগ্রস্থরা যেন টাকা ফেরত পায় সে বিষয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
অভিযুক্ত চন্দনীর নারী ইউপি সদস্য নার্গিস আক্তার মুঠোফোনে বলেন, আমার নামের অভিযোগের সঠিক প্রমান, সঠিক তথ্য ও সঠিক কাজ করে আপনি নিউজ করে দেন। আর আমার সামনে ক্যামেরা ধরলে আমি বক্তব্য দেবো না তো। আপনি যা পারেন, তাই নিউজ করে দেন। কিন্তু আমার সামনে ক্যামেরা ধরতে দেবো না।
এ সময় তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, আপনি উপজেলায় আসেন কথা বলি। কিন্তু ক্যামেরায় বক্তব্য দেবো না। আর টাকা কে নিয়েছে, সেসকল তথ্য ইউনিয়ন পরিষদে আছে। তার নিজের এলাকার লোকজনও জানে।
চন্দনী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুর রব বলেন, তার ইউপির নারী সদস্য নার্গিস আক্তার নির্বাচিত হবার আগে এবং পরে সরকারী বিভিন্ন প্রণোদনা ও সুবিধা দেবার কথা বলে গরিব, অসহায় ও দুঃস্থদের কাছ থেকে প্রকার ভেদে ৩ থেকে ৩২ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। বিনিময়ে অসহায় ব্যক্তিরা কিছুই দিতে পারেন নাই। পরবর্তীতে তিনি বিষয়টি জানার পর নারী ইউপি সদস্য নার্গিসকে তাগিদ দিলেও কোন লাভ হয় নাই। পরে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘ দিন নার্গিসের পেছনে ঘুরে কোন সুযোগ সুবিধা না পেয়ে পরিষদে তার বিরুদ্ধে ৭ জন লিখিত সহ অনেকে মৌখিক ভাবে তার কাছে অভিযোগ করেছেন।
তিনি আরও বলেন, অভিযোগ গুলো উপজেলা নির্বাহী বরাবর পাঠিয়েছেন। নির্বাহী অফিসার যে নির্দেশনা দেবেন, সে আলোকে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তিনি এই সব বিষয়ে নারী ইউপি সদস্যকে চাপ দেওয়াতে হয়তো তার বিরুদ্ধে আবোল তাবোল বলছেন নার্গিস।
রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মার্জিয়া সুলতানা বলেন, চন্দনীর এক মহিলা মেম্বরের বিরুদ্ধে মৌখিক ও পরে লিখিত কিছু অভিযোগ পেয়েছেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করা হচ্ছে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন পাবার পরে পরবর্তী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
তদন্ত কর্মকর্তা ও রাজবাড়ী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. খায়ের উদ্দিন আহমেদ বলেন, ইতিমধ্যে সরেজমিন তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। আশা করছি দ্রুতই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।