মোজাম্মেল হক লাল্টু : রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে অঞ্জনা বেগম-(৩৫)। তিন সন্তানের জননী। সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের দৈনিন্দন কাজ করেন। ছেলে-মেয়েকে স্কুলের পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরিবারের সকলের জন্য রান্নার কাজ শেষ করে।এর পর মাঠে গিয়ে কৃষকদের সাথে তাল-মিলিয়ে করেন কৃষি কাজ। সন্ধ্যায় মাঠের কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে আবারও শুরু করেন ঘরের দৈনিন্দন কাজ। ঘুম থেকে উঠে, ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব সময় পর্যন্ত অবসর নেই অঞ্জনা বেগমের।
অঞ্জনা বেগম বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে পুরুষদের পাশাপাশি কৃষি কাজ করি। এখন কৃষি কাজ করতে খারাপ লাগে না। তবে অনেক কষ্ট হয়। পরিবারের দৈনিন্দন কাজ করে কৃষি কাজ করতে হয়। সেই হিসেবে নারী কৃষক বলে কোন মূল্যায়ন পায়নি কখনও। কখনও পাবো কি না সেটাও বলতে পারি না। সুতরাং ঘরে বসে না থেকে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের কৃষি কাজ করার জন্য এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তিনি আরোও বলেন, ৪বিঘা জমিতে শুধু করলা লাগিয়েছি। অতি বৃষ্টিতে ২বিঘা জমির করলা নষ্ট হয়েছে। অন্য ২বিঘা জমিতে করলা খুব ভাল হয়েছে। বাজারে করলা ভাল দাম পেয়েছি। নষ্ট হয়ে যাওয়া করলা ক্ষতি পুশিয়ে অনেক লাভ হচ্ছে।
আরেক কৃষাণী সাত্তার মেম্বার পাড়ার আরশাদ মোল্লার স্ত্রী হাজরা খাতুন-(৬০)। তিনি বলেন, স্বামী-সন্তান নিয়ে অনেক সুখে-শান্তিতে বসবাস করেছি। একাধিকবার নদী ভাঙনের কারণে সব কিছু হারিয়েছি। অর্থ কষ্টে জীবন-যাপন করতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে এই বয়সে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে কৃষি কাজ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, পুরুষের সাথে কাজ করতে কোন সমস্যা নেই। তবে মজুরী নিয়ে কথা থেকে যায়। পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করেও মজুরী তাদের অর্ধেকের চেয়ে কম। যেখানে পুরুষ কৃষক মজুরী পায় ৫/৬শত টাকা। আমরা পাই ২-৩শত টাকা। প্রতিবাদ করলে কর্ম হারাতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে কাজ করতে হচ্ছে। এখন আমরা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। তিনি দুঃখ করে আরোও বলেন, কৃষি কাজ করে পুরুষের সমান হাজিরা পেলে আরোও অনেক নারী কৃষি কাজে আগ্রহী হবেন। সুতরাং নারীদের কৃষি কাজে আগ্রহী হওয়ার জন্য মুজুরী পুরুষের সমান করতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভূমিকা রাখতে হবে।
একই এলাকার কাশেম আলী শেখের স্ত্রী করিমন বেগম-(৫৫)। ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে এবং অসুস্থ্য স্বামী। পদ্মা নদীর ভাঙনের কবলে পরে হারিয়েছেন বসত ভিটা। হারিয়েছেন আবাদি জমি। এখন নিজের থাকার জন্য কোন জায়গা-জমি নেই। বাধ্য হয়ে অন্যের জায়গা লিচ নিয়ে কোন রকম ঝুঁপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছে।অসুস্থ্য স্বামী কোন কাজ-কর্ম করতে পারে না। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে মাঝে মধ্যে কৃষি কাজ করেন। সুতরাং সংসারের অভাবের তাড়নায় কৃষি কাজ করেন করিমন বেগম।
নারী কৃষক করিমন বেগম বলেন, স্বামী বাড়ীর ৭-৮ বিঘা আবাদি জমি ছিল। নদী ভাঙনের কারণে এখন কোন জায়গা জমি নেই। বাধ্য হয়ে এখন কৃষি কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের কাজ এবং অসুস্থ্য স্বামী সেবা। এর পর পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে মাঠে গিয়ে কৃষি কাজ করি। আবারও সন্ধ্যায় ঘরে এসে রান্না করতে হয়। তিনি বলেন, আমরা কাজ বেশি করি, কিন্ত মজুরী কম পাই। আমাদের মজুরী পুরুষের অর্ধেকের চেয়ে কম। তবে পুরুষের মত নারীরা মজুরী পেলে কোন নারী আর কাজের সন্ধানে বিদেশে যেত না। দেশে থেকে কৃষি কাজ করতো। কৃষি উন্নয়ন করতে চাইলে নারী কৃষকের মূল্যায়ন অবশ্যই করতে হবে। নারী কৃষকের মূল্যায়ন না করে কৃষকের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
গোয়ালন্দ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ খোকন উজ্জামান জানান, গোয়ালন্দ উপজেলায় অনেক নারী কৃষক আছে। তারা কৃষি কাজে পুরুষের চেয়ে অনেক সফল। অনেক নারী কৃষক আছে অন্যের জমিতে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করেন। এসকল নারীদের উৎসাহ তৈরি করতে পুরুষের সমান মজুরী করা প্রয়োজন।
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ উপপরিচালক এসএম সহীদ নুর আকবর জানান, রাজবাড়ী জেলার ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। রয়েছে অনেক নারী কৃষক। পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে কৃষি কাজ করে যাচ্ছেন অনেক নারী। অনেকে নিজের জমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করছে। তিনি আরোও বলেন, শুধু পুরুষ কৃষক নয়। নারী-পুরষ সকল কৃষকের পাশে রয়েছে কৃষি বান্ধব এই সরকার।