স্টাফ রিপোর্টার : পদ্মা নদীর তীরবর্তী ও রেলের শহর হিসেবে পরিচিত রাজবাড়ী। রেলের শহরের সুবাদে এ শহরে ১৫-২০ হাজার বিহারি বসবাস ছিল। শহরের নিউ কলোনি, আঠাশ কলোনি, স্টেশন কলোনি ও লোকোশেড কলোনি এলাকায় ছিল তাদের বসবাস। আর এ কারণেই রাজবাড়ীতে পাকিস্তান আমলে বিহারিদের খুব দাপট ছিল। বিপরীতে বাঙালিরা ছিল অসহায়। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর রাজবাড়ীর পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা অস্ত্রসমর্পণ করে ১৮ ডিসেম্বর।
রেলটাই ছিল তখন বিহারিদের দখলে। পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ীতে প্রবেশের পর বিহারিরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নির্বিচারে চালাতে থাকে জ্বালাও-পোড়াও ও গণহত্যা। অবশেষে দেশ স্বাধীন হলেও রাজবাড়ী স্বাধীন হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার দুই দিন পর শত্রুমুক্ত হয় রাজবাড়ী। রাজবাড়ীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো।
রাজবাড়ীর বিভিন্ন স্থানে ৮টি গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে পাংশা ও যশোর থেকে আরও কয়েকটি গ্রুপ এসে যুদ্ধে অংশ নেয়। এখানে মুক্তিবাহিনী, বিহারি, পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে তুমল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ জন্যই সারা দেশ যখন ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় অথচ রাজবাড়ী স্বাধীন হয়, তারও দুই দিন পর ১৮ ডিসেম্বর। এ দিন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে ফকির মহিউদ্দিন শহীদ হন। এ ছাড়া ওই দিন সকালে একাধিক শিশু যুবক ও বৃদ্ধকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
যুদ্ধকালীন কমান্ডার মো. আবুল হাসেম বাকাউল বলেন, ১৯৭১ সালে সৈয়দ খামারীর নেতৃত্বে রাজবাড়ীর অনেক মানুষকে হত্যার পর লোকৌসেড রেল কলোনির কূপে ফেলা হতো। পাশেই থাকা বর্তমান এতিমখানা ওই সময় এটি ছিল বিহারিদের গণহত্যার একটি নির্দিষ্ট স্থান। রাজবাড়ীতে বিহারিরা ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে অতিমাত্রায় তৎপর হয় ওঠে এবং পুরো শহর দখল করে রাখে। ৯ ডিসেম্বর শহরের লক্ষ্মীকোল এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। ওই দিন বিহারিদের গুলিতে রফিক, শফিক ও সাদিক শহীদ হন। ১৩ ডিসেম্বর বিহারিরা বিনোদপুর বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রহরীকে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও রাজবাড়ী শহর তখনো বিহারিদের কবল থেকে মুক্ত হয়নি। তারপর একে একে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিবাহিনী এসে জেলা শহরে সংগঠিত হয়। শহীদুন-নবী আলম, ফকীর আবদুর জব্বার, ইলিয়াস মিয়া, সিরাজ আহম্মেদ, আবুল হাসেম বাকাউল, কামরুল হাসান লালী, আবদুল মোতালেব হিরু, জলিল মাস্টার তাদের কমান্ডে মুক্তিযোদ্ধারা বিহারি কলোনিগুলো ঘিরে রাখে।
মুক্তিযোদ্ধা ও রাজবাড়ী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফকির আবদুল জব্বার বলেন, ১৭ ডিসেম্বর বিহারি ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা হয় ১৪ জন মেয়েকে, তারা কোনো ক্রমেই আত্মসমর্পণ করতে চায় না। তারা বলেছিল, হামরা লোরকে মরেগা। তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু। এতে অধিকাংশ পুরুষ মারা যায়। অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর বেলা ১টায় কয়েক হাজার বিহারি আত্মসমর্পণ করে, যাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল মহিলা। রাজবাড়ীতে ওই সময়ই ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।
তিনি আরও বলেন, শহরের বিনোদপুর লোকোসেড এলাকায় নির্মিত স্মৃতির বধ্যভূমি যখন নির্মাণ করা হয়। রাজবাড়ীতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে ৩৫ জন। মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, অবিলম্বে দেশের সব যুদ্ধাপরাধীকে যেন আইনের আওতায় এনে বিচার করা হয় এবং ফাঁসি দেওয়া হয়।