• সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০৩ পূর্বাহ্ন
শিরোনামঃ
গোয়ালন্দের তেনাপচা সঃ প্রাঃ বিদ্যালয় পরিদর্শনে ইউএনও পাংশায় ছাগল চোর চক্রের ২ সদস্য গ্রেপ্তার বালিয়াকান্দিতে পিপিআর রোগ নির্মূলে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন প্রদান রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে ভূল রিপোর্ট ! বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক পোস্টার উন্মোচন রাজবাড়ীর সুলতানপুরে পিপিআর রোগ নির্মূলে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন প্রদান গোয়ালন্দে পুলিশী অভিযান ফেন্সিডিল ও হেরোইনসহ ২মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার রাজবাড়ীতে নারী পুলিশ সদস্যদের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত রাজবাড়ীতে চ্যানেল আই’র ২৫ তম জন্মদিন পালিত বালিয়াকান্দিতে সংঘবদ্ধ চোর চক্রের ৬ সদস্য গ্রেপ্তার : স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা উদ্ধার

জায়গার অভাবে দু’টি প্রকল্পের কাজ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ : রাজবাড়ীতে গণকবর ও বদ্ধভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই

প্রতিবেদকঃ / ১২৪ পোস্ট সময়
সর্বশেষ আপডেট মঙ্গলবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২

সোহেল রানা : এ দেশের নিরীহ বাঙালীর ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গণহত্যা, নিরীহ, নির্দোষ মানুষকে গুলি করে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এসব মানুষের মৃতদেহকে দেয়া হয় গণকবর। সারাদেশের মতো রাজবাড়ী জেলার একাধিক স্থানে ঘটেছিল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অনেক গণকবর। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫১ বছর পরেও এসকল গণকবর চিহ্নিত করণের পাশাপাশি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান ও লাল-সবুজের পতাকা হৃদয়ে ধারণ করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা মানুষ।
জেলার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, রাজবাড়ী শহরের লোকোশেড, কালুখালী রেল স্টেশন সংলগ্ন মালিয়াটের ৩টি স্থানে, পাংশা উপজেলার মাগুড়াডাঙ্গি তিন চারা রেল ব্রীজ, মাছপাড়া রেল স্টেশন এলাকা এবং বালিয়াকান্দি উপজেলার শালবরাট, রামদিয়া, নারায়ণপুর, ঠাকুর নওপাড়া এলাকায় মিলেছে অসংখ্য গণকবরের সন্ধান। এর মধ্যে রাজবাড়ী জেলা শহরের লোকোশেডে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে কয়েক বছর আগে। অন্য সব গণকবর ও বধ্যভূমি এখনও অরক্ষিত ও অযত্নে পড়ে আছে। কিছু গণকবরের জায়গা ভূমিদস্যু কর্তৃক বেদখল হয়ে গেছে। রাজবাড়ী শহরের লোকোশেডের প্রবেশের কোন সড়ক নেই।
পাংশা উপজেলার মাগুড়াডাঙ্গি গ্রামের তিন চারা রেল ব্রিজের কাছে রয়েছে একটি বড় গণকবর। যেখানে মানুষকে ট্রেনে করে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মাগুড়াডাঙ্গি গ্রামের বাসিন্দা দেলবর আলী বলেন, সেদিন ছিল বৈশাখ মাসের ৫ তারিখ। তিনি তখন তিল কাটছিলেন ব্রিজের দোপে। তখন বেলা ১১টা থেকে ১২টা বাজে। একটি ট্রেন আসে থামে তিন চারা রেল ব্রিজের নিকট। ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাই। বিহারী আর সাদা পোশাক পরে রাজাকাররা একজনকে ট্রেন থেকে নামিয়ে ব্রিজের উপর নিয়ে গলা কেটে লাথি দিয়ে দোপে ফেলে দেয়। এমন করে ২১ জনকে ট্রেন থেকে নামিয়ে গলা কেটে হত্যা করে মরদেহগুলো ব্রিজের নিচে ফেলা দিয়ে যায়। ২১ জনের ভেতর থেকে ২ জন বেঁচে যায়। এক সপ্তাহ পরে ডোম-মেথররা দুটি গর্ত করে লাশগুলো মাটি চাপা দেয়।
রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য পাংশার মাছপাড়ার বাসিন্দা যুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন মিয়া বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন পাকসেনারা কালুখালী রেলস্টেশনে ক্যাম্প স্থাপন করে। রেলওয়ে জংশন থাকায় ভাটিয়াপাড়া, গোয়ালন্দ, রাজশাহী ও খুলনার সঙ্গে কালুখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সবচেয়ে ভাল ছিল। এসব এলাকা থেকে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে হত্যার পর কালুখালী বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দিত। শহীদদের সেই আত্মার জন্য বধ্যভূমি এলাকায় কোন দোয়ার ব্যবস্থা হয়নি। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে ছিল জায়গাটি। মাগুড়াডাঙ্গি পাংশার সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি হলেও এখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়নি।
অরক্ষিত বধ্যভূমি সম্পর্কে জানতে চাইলে কালুখালীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে সারাদেশের ১শ ৭৬টি বধ্যভূমি তালিকাভূক্ত করে। সেই তালিকায় উঠে আসে কালুখালীর বধ্যভূমি নাম। ওই সময় সেনাবাহিনীর একটি টিম স্থানীয়দের সহযোগীতায় জায়গাটি চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে ওই সময় ঘোষণা করা হয়েছিল সবগুলো বধ্যভূমি স্থান চিহ্নিত করার পর স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করে শহীদদের স্মরণ করা হবে। পরবর্তীতে থেমে যায় সেই কার্যক্রম। তারপর কেউ আর খবর রাখেনি কালুখালীর বধ্যভূমি ।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে কালুখালী উপজেলা প্রশাসন বধ্যভূমিতে ছোট পরিসরে ইটের স্তম্ভ তৈরি করে। পরে তাতে পুষ্পমাল্য প্রদান করে স্মরন করে শহীদদের। এরপর ২০১৭ সালে বধ্যভূমির তিন পাশ ওয়াল বাউন্ডারী দিয়ে ঘেরা হয়। তারপরও অরক্ষিত থেকে যায় কালুখালী বধ্যভূমি ।
ওই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী কালুখালীর মালিয়াটের বাসিন্দা রোকেয়া বেগম বলেন, তোমরা যেখানে বদ্ধভূমি করছো ওই স্থানই শুধু না। পাশের আম বাগান ও সিনেমা হলের নিচে মানুষের লাশ রয়েছে। বিহারি, রাজাকাররা দূর থেকে মানুষ নিয়ে এসে এসব স্থানে কোনোমত গর্ত করে লাশ মাটি চাপা দিয়ে চলে যেত। পরে প্রচণ্ড গন্ধ হতো। এলাকায় থাকা যেতো না। এ তিন স্থানে একশোরও বেশি লাশ আছে। চরের থেকে গরু ছাগল নিয়ে এসে রাজাকারেরা এখানে রান্না করে খেতো।
নজরুল ইসলাম জোয়াদ্দার বলেন, তিনি কালুখালীর বধ্যভূমির পাশ দিয়ে যতবার যান, ততবার একটি কথাই ভাবি স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও বধ্যভূমি অরক্ষিত কেন? আমি বধ্যভূমিতে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করে এর সুরক্ষার দাবি জানাই।
বালিয়াকান্দি উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মতিন ফেরদৌস বলেন, জেলার সবচেয়ে বড় গণকবরটি বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের শালবরাটে। যেখানে চার শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়াও রামদিয়া, নারায়ণপুর, ঠাকুর নওপাড়া এলাকায় চালানো হয়েছিল, নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। তবে ওইসব বদ্ধভূমি সংরক্ষণের জন্য এখনো নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।
পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া আকবর হোসেন পিন্টু বলেন, ওই সময় স্থানীয় হিন্দুরা তাদের স্বর্ণালংকারের নিরাপত্তার জন্য রামদিয়া স্টেশন মাস্টারের কাছে জমা রাখেন। ওই স্বর্ণালংকার স্টেশন মাস্টার আত্মসাৎ করলে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হন। স্টেশন মাস্টার বিহারীদের সাথে আঁতাত করে ফরিদপুর থেকে বিশেষ একটি ট্রেনে সেনাবাহিনী নিয়ে আসে। ট্রেনটি রামদিয়া স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই সেনা সদস্যরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ব্লাঙ্ক ফায়ার করতে থাকেন। এতে এলাকাবাসী বুঝতে পেরে যার যার মত পালাতে থাকেন। সেনা সদস্যরা স্টেশনে নেমেই ঠাকুর নওপাড়ার হিন্দু পল্লীর ভিতর দিয়ে আসতে শুরু করে। সে সময় তারা সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও নিমাই সরকার নামের দুইজনকে গুলি করে। তারা সেখানেই মারা যান। পরে মাঠের মধ্যে থেকে পাল মশাই কে গুলি করে হত্যা করে। এতে আমরা গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে বাড়ির সামনের রাস্তার উপর শতাধিক লোক দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার করতে থাকি। সেনাবাহিনীরা কাছে এসে ১৮ বছরের নিচের সবাইকে তাড়িয়ে দেয়। ফলে আমি বেঁচে যাই। পরে পুকুরের পাশে ১৯ জনকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখলেছুর রহমান দুলাল বলেন, তিনি যশোরে যুদ্ধ করছিলেন। তখন শুনতে পান বালিয়াকান্দিতে সেনা ঢুকবে। তিনি যশোর থেকে চলে আসেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে একটি ট্রেন আসে। ট্রেনটি নাওপাড়া, শালবরাট, নারায়ণপুর এলাকায় থামে। এসব জায়গায় সেনারা নেমেই হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ‘ব্রাশফায়ার করে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে। ওই সময় কেউ পালিয়ে যায়। কেউ পালাতে চেয়েও পারেনি। সেদিন এলাকার নিতাই চন্দ্র সরকার, সুরেন্দ্র নাথ সরকার, চন্ডী সাহা, চুনী সাহা, প্রমিলা রানী, কালীদাসী, চণ্ডিদাসীসহ অনেক মানুষকে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। এ তিনটি জায়গায় কম করে হলেও এক হাজার মানুষকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।
বীরমুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘১৯৭১ সালে রাজাকার, বিহারি, পাকিস্তানি বাহিনী, মিলিশিয়ারা মিলে গ্রামে গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তারা গুলি করে, কুপিয়ে মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। রাজবাড়ীর গণকবরগুলো অযত্নে পড়ে আছে। আজ পর্যন্ত কেউ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। এসব গণকবর সংরক্ষণ করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
রাজবাড়ী গণপূর্ত অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, রাজবাড়ী লোকসেডে একটি বদ্ধভূমি নির্মাণ করা হয়েছে। পাংশার চারা রেলব্রীজের নিকট জায়গা না থাকায় ও কালুখালী বদ্ধভূমির স্থান নদীর মধ্যে হওয়ায় প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও জায়গা না থাকায় কাজ করা সম্ভব হয়নি। অন্যান্য গুলো আমাদের তালিকায় নেই।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ

সর্বশেষ সংবাদ

error: Sorry buddy! You can\'t copy our content :) Content is protected !!