এজাজ আহম্মেদ : রাজবাড়ীতে ১৫ বছর ধরে প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক অবসরপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত তিনি স্বেচ্ছায় এই কাজটি করে যাচ্ছেন।
তাঁর নাম শান্তি ভূবন দাস (৭৩)। তিনি রাজবাড়ী শহরের দক্ষিণ ভবানীপুরের মাস্টারপাড়া এলাকার বাসিন্দা। শান্তি ভূবন দাসের পৈতিক নিবাস কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ইছাপুরা গ্রামে। বাবার নাম পায়েরী মোহন দাস। দাম্পত্যজীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রী নমিতা দাস গৃহিনী। বড় ছেলে কামনাশীষ দাস তাঁতবোর্ডের মহাব্যবস্থাপক। ছোট ছেলে দেবাশিষ দাস অটো মোবাইল প্রকৌশলী। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১৯৭৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কার্যসহকারী হিসেবে সরকারি চাকুরীতে যোগদান করেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ফরিদপুর। এরপর ১৯৮১ সাল থেকে ’৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি রাজবাড়ীতে কর্মরত ছিলেন। আবার ১০৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি হিসাবরক্ষন কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরি থেকে অবসর নেন। শহরের ভবানীপুরে তিনি কুশল ড্রিংকিং ওয়াটার নামে পানি বিপণন (জারের মাধ্যমে বিক্রি করে) প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের রত্মা কমিউনিটি সেন্টারের দক্ষিণপাশ দিয়ে মাস্টারপাড়ার ভেতর একটি রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার মাঝখানে স্ল্যাব। সকাল ৭ বাজতে না বাজতেই পুরো রাস্তা পরিস্কার করা হয়েছে। শীতের সকাল হওয়ায় রাস্তায় তেমন মানুষের যাতায়াত নেই। রাস্তার দুই পাশে বহুতল ভবন। দুই একটি বাড়ি ছাড়া অধিকাংশ বাড়িই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বারুগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কনা রানী দাস বলেন, ‘আমরা তাকে মামা বলে ডাকি। তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন ভালো মানুষ। তিনি কাজকে ছোট মনে করেন না। প্রতিদিন সকালে উঠে তিনি রাস্তা পরিস্কার করেন। প্রতিবেশীদের বাড়ির প্রাচীরে জমে থাকা আগাছা, ধূলা পরিস্কার করেন। এমনকি রাস্তার পাশে যেসব বাড়িতে বয়স্ক লোকজন থাকে তাদের বাড়ির উঠানও তিনি পরিস্কার করে দেন। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কারনে আমাদের এই এলাকায় করোনারও তেমন কোনো উপদ্রব হয়নি। তাকে নিয়ে সত্যি গর্ব করা যায়।
প্রতিবেশী ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ভিপিকেএ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক হাফিজ আল আসাদ বলেন, ‘তিনি আমার বাবার বন্ধু। আমার বাবাও পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকুরি করতেন। তবে ঝাড়ু দেওয়ার শুরু থেকেই আমরা বিষয়টি জানতাম না। ভাবতাম, পৌরসভার লোকজন পরিস্কার করেছে। কারণ, আমরা ঘুম থেকে উঠেই পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা পেতাম। একদিন সকালে দেখি শান্তি কাকু ঝাড়ু দিচ্ছেন। এরপর আরও কয়েক দিন দেখি। এরপর কাকুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করে জানতে পারি, নিজের ভাললাগা থেকেই তিনি ঝাড়ু দেন।’
তাঁর স্ত্রী নমিতা দাস বলেন, ‘প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। একে তো ভোরে উঠে বের হতো। আবার অনেকে নানা ধরণের কুটুক্তি করতো। ‘আপনার কি সুইপারের ঘরে জন্ম নাকি’, ‘উনি নিচু ঘরের মানুষ নাকি’, ‘পৌরসভা থেকে কত বেতন দেয়’ এ ধরণের নানা কথা বলতো। কিন্তু তিনি কারও কথায় কান না দিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছেন। শীত-গ্রীষ্ম নেই। প্রতিনিয়ত তিনি এই কাজ করে চলছেন।
তিনি বলেন, এখন আর কেউ কটু কথা বলে না। বরং এক দিন ঝাড়ু না দিয়ে সবাই ভাবে তিনি অসুস্থ। বাড়িতে সবাই খোঁজ খবর নিতে আসে। সবাই এই বিষয়টি এখন খুব প্রশংসা করে। টুকটাক সহযোগিতাও করে। যেমন, ময়লা পোড়ানোর সময় সঙ্গে দিয়াশলাই না থাকলে এনে দেয়। কাজ করার সময় গল্প করে। আর সবমিলিয়ে বিষয়টি আমারও খুব ভালো লাগে।
নমিতা দাস বলেন, রাস্তার স্ল্যাব ভেঙে গেলেও তিনি সেটি মেরামত করে দেন। এখন পর্যন্ত ১১ টি স্ল্যাব তৈরি করে দিয়েছেন। আর তিনটি দিয়েছে স্থানীয়রা। এমনকি বাড়ির কাঁথা, সোয়েটার নিয়েও রেলস্টেশন বা অসহায় মানুষকে দিয়ে আসে।
শান্তি ভূবন দাস বলেন, আমি আগে থেকে আমার বাড়ির উঠান পরিস্কার করতাম। আমার বড় ছেলে পরিবেশের ওপর ডক্টরেট ডিগ্রী সম্পন্ন করেছে। আমিও পরিবেশ নিয়ে সচেতন ছিলাম। বাড়ির আশেপাশে পরিস্কার রাখতাম। ২০০৭ সাল থেকে বাড়ির সামনের রাস্তা পরিস্কার করা শুরু করি। আর পরিকল্পনা করি, অবসরে গেলে পুরো রাস্তা পরিস্কার করবো। আমি পরিকল্পনা মতোই কাজ করেছি। অবসর নেওয়ার দিন থেকে পুরো রাস্তা পরিস্কার করা শুরু করেছি। ২০০৯ সালের প্রথম দিন থেকেই আমার কাজ শুরু করি।
তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠি। এরপর বেড়িয়ে পড়ি। প্রধান সড়কের সংযোগ রত্ম কমিউনিটি সেন্টার থেকে ঝাড়ু দেওয়া শুরু করি। সেখান থেকে রাস্তার শেষের শ্যামল মন্ডলের বাড়ি পর্যন্ত পরিস্কার করি। এরপর প্রয়াত সাংবাদিক হিমাংশু সাহার বাড়ি থেকে ভক্ত স্যারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পরিস্কার করি। এরপর উত্তম কুমার সরকারের বাড়ি থেকে বুদ্ধুদের বাড়ির গলি পরিস্কার করি। এসব কয়েকটি স্থানে জড়ো করে রাখি। এরপর তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলি। আর কিছু দিন পরপর রাস্তার আশেপাশের আগাছা পরিস্কার করি। এসব করার পর সকাল ৭টার দিকে বাড়িতে যাই। বাড়ি গিয়ে গোসল করে পূজা-অর্চনা করি। তারপর সকালের নাস্তা। সকাল ১০টার দিকে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাই। দুপুর ২টার দিকে বাড়িতে আসি। খাওয়া-দাওয়ার পর পত্রিকা পড়ি। টেলিভিশন দেখি। তবে কখনোই দুপুরে ঘুমাই না। বিকেলে আবারও আমার প্রতিষ্ঠানে যাই। সন্ধ্যায় বাড়িতে আসি। রাত ৯টার দিকে বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ি।
শান্তি ভূবন দাস বলেন, আমি সাধারণত অসুস্থ হইনা। কারণ আমি সকালের একটি নির্মল বাতাস পাই। কারণ আমার আগে সাধারণত কেউ রাস্তা দিয়ে চলাচল করে না। এরপর রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ায় আমার ভালো ব্যায়ামও হয়ে যায়। হাড় কাপানো শীতের মধ্যেও কিছু সময় কাজ করলে আমি ঘেমে যাই। আর ঘামলেই তো দূষিত রক্ত বা পদার্থ শরীর থেকে বের হয়ে যায়। পরিশ্রম করার পর বাড়িতে গিয়ে গোসল করার পর আমি পুরোপুরি ফ্রেস মানুষ হয়ে যাই।
রাজবাড়ী পৌরসভার কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র শেখর চক্রবর্তী বলেন, ‘ বিষয়টি আমি জানি। তিনি নিজের উদ্যোগে রাস্তা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। অনেক দিন ধরে তিনি এই কাজ করে চলছেন। এজন্য তাকে শুধু আমি নয়, পুরো পৌরসভাবাসীর উচিত তাকে সাধুবাদ জানানো, তাকে ধন্যবাদ দেওয়া।