শামীম শেখ : নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার জীবনের গ্লানি কাটিয়ে দেশ সেরা জয়িতা নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন মর্জিনা বেগম নামের এক নারী। জয়িতা অন্বেষনে বাংলাদেশ – শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় ২০১৭ সালে তিনি এ গৌরব অর্জন করেন। ৮ মার্চ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তজার্তিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় জয়িতাদের এ সম্মাননার আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি-এম.পি। অনুষ্ঠানে ‘‘ নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী ’’ ক্যাটাগরিতে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার স্বীকৃতি অর্জন করেন মর্জিনা বেগম।
শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি হিসেবে মর্জিনা বেগমের হাতে সনদপত্র, ক্রেষ্ট ও ৫০ হাজার টাকার একটি চেক তুলে দেয়া হয় । মর্জিনা বেগম রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার বাসিন্দা। পেশাগত জীবনে তিনি মুক্তি মহিলা সমিতি নামে একটি বেসরকারি সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক। সংগঠনটি দেশের সর্ববৃহৎ দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর যৌনকর্মী ও তাদের সন্তানদের অধিকার আদায়, শিশুদের বিকাশ, শিক্ষা,সুরক্ষা, সুস্বাস্থ্য, ন্যায় বিচার, নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে। সেভ দ্যা চিলড্রেন সহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা এতে সহযোগিতা করে। সংগঠনটিতে অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা ও কর্মী কাজ করেন। এর মধ্যে নারী কর্মীদের অধিকাংশই যৌনপল্লী সংশ্লিষ্ট। যারা এ সংস্হার মাধ্যমে এখন সামাজিকভাবে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন।
“মর্জিনার সংগ্রামী জীবনের গল্প”
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের আড়ৎপট্টি এলাকার করিম মোল্লা ও চম্পা বেগমের ঘরে ১৯৬৬ সালে জন্ম হয় মর্জিনা বেগমের। ৩ বোনের মধ্যে মর্জিনা সবার বড়। বাবা একজন সাধারন ফল ব্যাবসায়ী ছিলেন। সংসার চলত টানাটানির মধ্যে। বাবার মৃত্যুর পর। নানার কাছে মানুষ হয় মর্জিনা বেগম সহ তিন বোন। মর্জিনার বয়স তখন মাত্র ৬ বছর। নানা গোয়ালন্দ ঘাটের ইজারাদার ও মুদি দোকানী ছিলেন।অভাবের সংসারে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মর্জিনাকে বিয়ে দিয়ে দেন। স্বামী ফরিদপুরের টেকেরহাট দিপনগর এলাকায় ফার্নিচারের দোকানদার রব মৃধা। তিনি ছিলেন তিন সন্তানের বাবা। মর্জিনা দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়ের কয়েকমাস পরেই মর্জিনার গর্ভে সন্তান আসে। তারপর সে নানাবাড়ী গোয়ালন্দে বেড়াতে আসে। এরপর তার স্বামী তাকে তাকে পাহাড়ী এলাকায় নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মর্জিনা বেগম বলে, আমার গর্ভে সন্তান আর আমি পাহারকে ভয় পাই।তাছাড়া সেখানে কোন আত্বীয়-স্বজন নেই। তখন স্বামী গোয়ালন্দ ঘাট থানায় লিখিত অভিযোগ দেয় সে আমাকে নিয়ে যেতে চায়। তখন ওসি বলে মর্জিনার গর্ভে সন্তান জন্ম হওয়ার পর আপনি মার্জিনাকে নিয়ে যেতে পারবেন এবং মর্জিনা ছোট হওয়ায় কিছু কাজ থেকে বিরতি রাখতে পরামর্শ দেন। কিন্তু স্বামী রব কোন কথা না শুনে রাগ করে গোয়ালন্দ ছেড়ে চলে যায়। এর পর হতে তার স্বামী তাদের আর কোন খোঁজ-খবর নেয়নি। এর কিছুদিন পর জন্ম হয় একটি মেয়ে সন্তান। সেই থেকেই স্বামী ছাড়া একটি কন্যা শিশু নিয়ে শুরু হয় আমার জীবন সংসার। ১৯৮০ সালে নানা মারা যায়। সংসারে নানী, মা, তিনটি বোন এবং একটি মেয়ে সন্তান নিয়ে অতিকষ্টে সংসার চলতো পিঠা বিক্রী করে। এলাকার লোকজন অনেকেই তাকে বাজে ইঙ্গিত করত। এমতবস্হায় প্রতিবেশী এক মহিলা তাকে ঢাকার একটি বাসায় আয়ার চাকরী দেয়ার কথা বলে। আমি রাজি হয়ে চলে যাই।
কিন্তু একমাত্র ছোট সন্তান বাড়িতে থাকায় ৭ দিন পর সে গোয়ালন্দে চলে আসে। এদিকে সংসারে কষ্টের কারণ এবং এলাকার লোকদের ব্যবহার ভালো না হওয়ায় একদিন কাউকে কোনকিছু না বলে বাড়ী থেকে বের হয়ে সিরাজগঞ্জ চলে যাই। রাস্তায় কান্নাকাটি করতে ছিলাম এমন সময় এক লোক এসে বলে তুমি যৌনপল্লীতে থেকে যাও। আমি রাজি হই। কোন উপায় না থাকায় শুরু হয় যৌনকর্মীর জীবন। সিরাজগঞ্জ যৌনপল্লীতে ছিলাম ৫ মাস। ১৯৮৮ সালে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে আসেন দৌলতদিয়া পোড়াভিটা যৌনপল্লীতে। রোজগারের টাকা দিয়ে সেখানে রেলওয়ে থেকে ৮ শতাংশ জায়গা লিজ নেই। কিন্তু আপন ছোট বোন কল্পনা জায়গাটি দখল করে নেয়। ১৯৯১ সালে পোড়াভিটার যৌনপল্লী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় । তখন চলে আসি দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে আবার ১শতাংশ জায়গা নিয়ে শুরু হয় দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর বাড়ীওয়ালী হিসেবে পথচলা। ১৯৯৮ সালে একটি সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষে ১১জনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সংগঠনের নাম দেয়া হয় মুক্তি মহিলা সমিতি (এমএমএস)। ১৯৯৯ সালে যৌনকর্মীদের জুতা পরে বাহিরে যাওয়া, মারা গেলে দাফনের ব্যবস্থা করা, শিশুদের শিক্ষার সুযোগ দেয়া, স্বাস্থ্য সেবা, ভোটাধিকার, বিনা অপরাধে অত্যাচার বন্ধ করাসহ বিভিন্ন দাবিতে আয়োজন করা হয় যৌনকর্মীদের সম্মেলন। সম্মেলন সফল হয়। ওই বছরই আমরা আমাদের “মুক্তি মহিলা সমিতি” সংগঠনটির সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন লাভ করি। যার নম্বর রাজ-১৭০/৯৯। ছোট্র টিনের ঘর থেকে সংগঠনটির এখন সুরম্য একটি কার্যালয় রয়েছে। আলাপকালে মর্জিনা বেগম জানান, ২০০১ সালে যৌনকর্মীদের বিনা অপরাধে মারধর, ধরে নেওয়া এবং ছিনতাইয়ের প্রতিবাদ করায় তিনিসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ যৌনকর্মী ও নেত্রী জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন। জেল খাটেন ১৬ দিন। পল্লীর প্রভাবশালী চক্রের থেকে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি আসতে থাকে। কিন্তু কোন কিছুতেই তিনি দমে যাননি। তখন থেকে অদ্যাবধি পল্লীর নারী ও শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে তার সংগ্রাম চলছে।এতদিন পরে এসে এখনো পল্লীর মাদক ব্যাবসায়ী, নারী পাচারকারী ও সন্ত্রাসীদের নানা ধরনের হুমকি-ধমকি তাকে মোকাবিলা করতে হয়। প্রাননাশেরও হুমকি আসে। তবে যতদিন দেহে প্রান আছে, ততদিন নির্যাতিত নারী ও শিশুদের জন্য কাজ করে যাবেন বলে তিনি অঙ্গীকার করেন।জাতীয় জয়িতা পদক পাওয়ার বিষয়ে তিনি সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া আদায় করেন এবং এর পেছনে যারা তাকে পেছন থেকে সহায়তা করেছেন তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।