হযরত মাও: আবু নাছির আহম্মেদ
হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম, যাকে আরবের অন্ধকার যুগেও বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হতো। আবার চার সম্মানিত মাসের প্রথম মাসও মহররম। শরিয়তের দৃষ্টিতে যেমন এ মাসটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি এই মাসে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ ও অনেক দীর্ঘ। আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী মহররম মাস। ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয় এ মাসে। শুধু উম্মতে মুহাম্মদিই নয়, বরং পূর্ববর্তী অনেক উম্মত ও নবীদের অবিস্মরণীয় ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল এই মাসে।
মহররম মাসের ফজিলত
নামকরণ থেকেই প্রতীয়মান হয় এ মাসের ফজিলত। মহররম অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য ও রহস্যময় তাৎপর্য নিহিত রয়েছে এ মাসকে ঘিরে, সঙ্গে সঙ্গে এমাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল, এসব কারণেই এমাসটি মর্যাদাপূর্ণ। তাই এমাসের নামকরণ করা হয়েছে মহররম বা মর্যাদাপূর্ণ মাস।
মহররম সম্পর্কে (যা আশহুরেহুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাসের সংখ্যা ১২। যেদিন থেকে তিনি সব আসমান ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারটি হলো সম্মানিত মাস। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং তোমরা এমাস গুলোর সম্মান বিনষ্ট করে নিজেদের প্রতি অত্যাচার করোনা। (সূরা তওবা: ৩৬)
অর্থাৎ সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে আল্লাহ তায়ালা ১২টি মাস নির্ধারণ করেছেন। তন্মধ্যে চারটি মাস বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে।
ওই চারটি মাস কি কি ? এর বিস্তারিত বর্ণনা হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, এক বছরে ১২ মাস। এর মধ্যে চার মাস বিশেষ তাৎপর্যের অধিকারী। এর মধ্যে তিন মাস ধারাবাহিক ভাবে (অর্থাৎ জিলকদ, জিলহজ ও মহররম) এবং চতুর্থ মাস মুজর গোত্রের রজব মাস।(সহিহ বোখারি: ৪৬৬২ ও মুসলিম: ১৬৭৯)
আশুরার দিনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী
মহররম মাস সম্মানিত হওয়ার মধ্যে বিশেষ একটি কারণ হচ্ছে- আশুরা (মহররমের ১০তারিখ)। এ বসুন্ধরার ঊষালগ্ন থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত হয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ও হৃদয় বিদারক কাহিনী।
ইসলাম ধর্ম মতে, আশুরার দিনে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। আশুরার দিন আল্লাহ পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে আল্লাহ নবীদেরকে স্বস্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছেন। এই দিন হযরত নুহ (আ.) এর প্লাবন শেষ হয় এবং নুহ (আ.) এর জাহাজ তুরস্কে র‘জুদি’ নামক পর্বতে গিয়ে থামে। আশুরার দিন হযরত ইব্রাহিম (আ.) জালিম বাদশাহ নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে নিরাপদে মুক্তি পেয়েছিলেন। এই দিন হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। আশুরার দিনে হযরত আইয়ুব (আ.) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
আশুরার দিন হযরত সুলাইমান (আ.) তার হারানো রাজত্ব ফিরে পান। এই দিনে হযরত ইয়াকুব (আ.) হারানো ছেলে হযরত ইউসুফ (আ.) কে ৪০ বছর পর ফিরে পেয়ে ছিলেন। এই দিনে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এই দিনেই তাকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়।
সর্বশেষ ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে ওই দিনে ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন।
আশুরার রোজা
মহররম মাসে রোজা রাখা সম্পর্কে অনেক বিশুদ্ধ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। বিশেষ ভাবে আশুরা, অর্থাৎ মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয়, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর ফরজ ছিল। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই ওই বিধান রহিত হয়ে যায় । হাদিস শরিফে হজরত জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এবিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেননা এবং নিষেধও করতেন না। আর এবিষয়ে তিনি আমাদের খবরা খবর ও নিতেন না। (সহিহ মুসলিমশরিফ: ১১২৮)
ওই হাদিসের আলোকে আশুরার রোজার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতীয়মান হয়। এমনকি ওই সময়ে তা ফরজ ছিল। বর্তমানে এই রোজা যদিও নফল, কিন্তু অন্যান্য নফল রোজার তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে সেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন না।(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
আশুরার রোজার ফজিলত
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এই রোজা নিজে পালন করেছেন এবং উম্মতকে রাখার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তাই এরপূর্ণ অনুসরণও আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে উম্মতের কল্যাণ। এছাড়া অসংখ্য হাদিসে আশুরার রোজার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
আশুরার রোজার পদ্ধতি
মুসলিম শরিফে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘ মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদের ও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়ারাসূলাল্লাহ! ইহুদি-নাসারারাতো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। (আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন, ‘তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে) আগামী বছর ইনশা আল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯তারিখ মিলিয়ে দুইদিন রোজা পালন করব।(সহিহ মুসলিম: ১১৩৪ )
আশুরার দিনে অন্য আমল
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবার-পরিজনের মধ্যে পর্যাপ্ত খানা পিনার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ পাক পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দান করবেন। (তাবরানি: ৯৩০৩)
উল্লিখিত হাদিস সম্পর্কে আল্লামা ইবনুলজা ও যিসহ অনেক মুহাদ্দিস আপত্তি জনক মন্তব্য করলেও বিভিন্ন সাহাবি থেকে ওই হাদিসটি বর্ণিত হওয়ায় আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতিসহ অনেক মুহাক্কিক আলেম হাদিসটিকে গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।(জামিউস সগির: ১০১৯)
অতএব যদি কেউ উপরোক্ত হাদিসের ও পর আমল করার উদ্দেশ্যে ওই দিন উন্নত খানা পিনার ব্যবস্থা করে, তাহলে শরিয়তে নিষেধ নেই। তবে স্মরণ রাখতে হবে, কোনো ক্রমেই যেন তা বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনের স্তরে না পৌঁছে।